মানসিক স্বাস্থ্য: ট্যাবু ভাঙার সময় এখন

দেশজুড়ে

সিনিয়র রিপোর্টার মোহাম্মাদ তারিক উদ্দিন

১. বর্তমান চিত্র: কোথায় দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ
• ২০১৯ সালের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুসারে, প্রাপ্তবয়স্কদের ১৯% মানসিক অসুস্থতায় ভুগে, যা আগের জরিপের ১৬.১% থেকে বেড়েছে ।
• প্রায় ৯০% রোগী মেন্টাল হেলথ সেবা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত—তাতে রয়েছে বার্নআউট, অবসাদ ও অন্যান্য মানসিক সমস্যা ।
• বিশেষ করে আসক্তি (addictive disorders) ক্ষেত্রে চিকিৎসার গ্যাপ সর্বোচ্চ (৯৫.২৪%), এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম (৬৫.৬৩%) ।

২. ট্যাবু এবং সামাজিক বাধা
• “লোকের কী বলবে” ভয়ে অনেক পরিবারই মানসিক সমস্যাগুলোকে অস্বীকার করে কিংবা অসমর্থন দেয়, ফলে সমস্যা দমিয়ে রাখা হয় ।
• ছেলেরা বিশেষভাবে মানসিক কষ্ট প্রকাশে বাধাপ্রাপ্ত—সাহসিকতা ও “মার্জিত স্বভাব” বজায় রাখার ভীতি মানসিক কষ্টকে আরও বাড়িয়ে তোলে ।
• শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা স্কুল পর্যায়ে তৎক্ষণাৎ সনাক্ত ও মোকাবিলা না করা পরিবারে ও শিক্ষাব্যবস্থায় ট্যাবু বাড়িয়ে তোলে ।

৩. চ্যালেঞ্জ: সেবা পৌঁছানো ও গ্রহণযোগ্যতা
• সরকারিভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার বিস্তৃতি সীমিত, বরং তা প্রধানত শহরে কেন্দ্রীকৃত—গ্রামীণ ও দূরবর্তী অঞ্চলে পরিমিত সুবিধা  ।
• সরকারি হাসপাতালগুলো (যেমন NIMH, Mitford, BSMMU, DMCH) সাশ্রয়ী কাউন্সেলিং সেবা দেয়, কিন্তু প্রাইভেট সেবা ব্যয়বহুল এবং অনেকের পক্ষে ধরে না ।
• স্বল্প পরিমাণ মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট—এতেই সেবা গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয় ।

৪. ইতিমধ্যের উদ্যোগ ও সম্ভাবনাময় পথ
• WHO-এর “Special Initiative for Mental Health” বাংলাদেশের জন্য ২০২৪ থেকে মানসিক স্বাস্থ্যকে স্বতন্ত্র ডিরেক্টরেট হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে, এবং সামগ্রিক সেবার সম্প্রসারণ, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ও টেলিমেডিসিন সেবা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে ।
• UNICEF এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় যৌথভাবে স্কুলভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য ও মাইন্ডসেট প্রোগ্রাম (MHPSS) বাস্তবায়ন করছে—এতে মানসিক সুস্থতা জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংহত করাJoy হচ্ছে ।
• ২০২৫-এর Mental Health Awareness Week বাংলাদেশে ১২-১৮ মে অনুষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির একটি সামাজিক-মানসিক প্রচারাভিযান শুরু হয় ।

৫. বিশেষ অবস্থা: শহরবাড়ি ও নারী
• শহরের দারিদ্রসীমার slum এলাকায় ঘরোয়া সহিংসতা (IPV) ভুক্তভোগী নারীরা মানসিক সহায়তায় পৌঁছাতে চায়, কিন্তু সেবা বিষয়ে অজ্ঞতা, সামাজিক কলঙ্ক এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা প্রধান বাধা ।
• মানসিক স্বাস্থ্য সেবার অব্যাহত অপ্রতুলতা ও তথ্যের অভাব—কটাক্ষ ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে যথেষ্ট বাধা সৃষ্টি করে ।

৬. বিশ্লেষণ: ট্যাবু ভাঙার ‘সময় এখনই’
• মানসিক স্বাস্থ্য এখন স্বাস্থ্য অধিকার–এর অন্তর্ভুক্ত ও সাধারণ স্বাস্থ্যসেবার ধারায় নেওয়ার সময়।
• নীতিগত উদ্যোগ (যেমন WHO-এর প্রস্তাবিত ডিরেক্টরেট, স্কুল-ভিত্তিক MHPSS), সামাজিক সচেতনতা (Awareness Week, শিক্ষাপ্রচার) এবং সেবা সম্প্রসারণ—এসব যৌথভাবে ট্যাবু ভাঙার শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে পারে।
• সাংস্কৃতিক বাধা, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও লিঙ্গগত ভিন্নতা—এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রচার, মহেশ্বরীয় প্রযুক্তি (টেলিমেডিসিন), গ্রামীণ-ক্ষুদ্র স্তরে ক্ষমতাবৃদ্ধি—অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৭. আত্মহত্যার ঝুঁকি ও পরিসংখ্যান
• বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১০-১২ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে (BRAC University ও WHO তথ্য অনুযায়ী)।
• বিশেষভাবে কিশোর ও তরুণ বয়সীদের আত্মহত্যার হার বাড়ছে। সামাজিক চাপ, শিক্ষাজনিত স্ট্রেস, সম্পর্কজনিত সমস্যা এবং বেকারত্ব এর মূল কারণ।
• WHO-এর মতে, আত্মহত্যা এখন বিশ্বে ১৫-২৯ বছর বয়সী তরুণদের দ্বিতীয় প্রধান মৃত্যুর কারণ। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

৮. কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য
• সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৬ জনের মধ্যে ১ জন কর্মী কর্মক্ষেত্রের স্ট্রেসে ভোগেন।
• কর্পোরেট সেক্টরে “Burnout” বা চরম মানসিক ক্লান্তি ব্যাপকভাবে দেখা দিচ্ছে।
• অনেক কোম্পানি এখন “Employee Assistance Program (EAP)” চালু করছে, যেখানে কর্মীদের জন্য কাউন্সেলিং সেবা বিনামূল্যে বা স্বল্প খরচে দেওয়া হয়।

৯. কোভিড-১৯ পরবর্তী মানসিক সংকট
• মহামারীর সময় বাংলাদেশে ডিপ্রেশন ৩ গুণ বেড়েছিল, এবং উদ্বেগ বা অস্থিরতায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২ গুণ হয়।
• WHO বলছে, কোভিড-১৯–এর পর বিশ্বের প্রায় ২৫% মানুষ নতুন করে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন।
• বাংলাদেশে অনলাইন কাউন্সেলিং, হেল্পলাইন ও টেলিমেডিসিন সেবার চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায়—যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

১০. প্রযুক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্য সেবা
• বাংলাদেশে এখন কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু হয়েছে—যেমন Moner Bondhu, Mind Tale, PsychBD, যেখান থেকে মানুষ ২৪/৭ সাপোর্ট পাচ্ছেন।
• টেলিমেডিসিন ও মুঠোফোন অ্যাপের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছানোর নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
• তবে ডিজিটাল সেবায় আস্থা, গোপনীয়তা রক্ষা এবং প্রশিক্ষিত মনোবিজ্ঞানীর উপস্থিতি এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

১১. আন্তর্জাতিক তুলনা ও শিক্ষা
• ভারত: ২০২৩ সালে তারা “National Tele-Mental Health Programme” চালু করেছে, যা ২৪ ঘণ্টা ফ্রি হেল্পলাইন ও অনলাইন কাউন্সেলিং সেবা দিচ্ছে।
• শ্রীলঙ্কা: স্কুল পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
• বাংলাদেশ এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যা ও ড্রপআউটের হার কমতে পারে।

১২. সামনে এগোনোর পথ – সুপারিশ
1. স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
2. কমিউনিটি ক্লিনিকে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা যুক্ত করা—প্রাথমিক পর্যায়েই সমস্যা শনাক্ত করা যায়।
3. সামাজিক সচেতনতা প্রচারণা (Mass Awareness) চালানো—“মানসিক অসুস্থতা = দুর্বলতা নয়, চিকিৎসাযোগ্য সমস্যা।”
4. কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন—কর্মীদের সাপোর্ট সিস্টেম নিশ্চিত করা।
5. অনলাইন ও টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্ম শক্তিশালী করা, যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সেবা পান।
6. ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের সম্পৃক্ত করা—কারণ অনেকে প্রথমে ইমাম, শিক্ষক বা স্থানীয় নেতার কাছে সাহায্য চান।

পরিশেষে আজকের বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং জাতীয় উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতার সাথেও জড়িত।
যদি আমরা এখনই ট্যাবু ভাঙতে পারি, সচেতনতা বাড়াই এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে সাধারণ স্বাস্থ্যসেবার অংশ করি—তাহলেই একটি মানসিকভাবে সুস্থ, প্রোডাক্টিভ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *