সিনিয়র রিপোর্টার মোহাম্মাদ তারিক উদ্দিন : বাংলাদেশে চলতি বর্ষায় নদীবিধ্বস্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল যখন ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত, তখন বঙ্গোপসাগরের গভীরে একাধিক ভূমিকম্প নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা—এই ভূমিকম্পগুলো সুনামি, ভূমিধস কিংবা বাঁধ ভাঙনের মাধ্যমে দেশের ইতোমধ্যে সংকটাপন্ন বন্যা পরিস্থিতিকে আরও ঘনীভূত করতে পারে।⸻চলমান বন্যা পরিস্থিতি: নদী-নালায় পানি থইথইবাংলাদেশে ২০২৫ সালের জুন-জুলাই জুড়ে ভারী বর্ষণ এবং ভারত থেকে নেমে আসা উজানের পানির কারণে দেশের অন্তত ২০টি জেলা প্লাবিত হয়েছে।বড় বড় নদী যেমন ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা, তিস্তা ও কর্ণফুলী—সবখানেই পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:• ✅ ফেনী: ৬,৯৫০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত, শতাধিক ঘরবাড়ি ধ্বংস, প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত।• ✅ নোয়াখালী: ৬৩,৮৬০ জন পানিবন্দি, অধিকাংশ সড়ক ও বিদ্যালয় জলাবদ্ধ।• ✅ কক্সবাজার: পাহাড়ি ঢল ও নদীভাঙনে ব্যাপক ক্ষতি, আশ্রয়কেন্দ্রেও জায়গা সংকট।স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি রেড ক্রিসেন্ট, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (WFP), ও UNDP জরুরি সহায়তা চালু করেছে। তবে অনেক এলাকাতেই ত্রাণ পৌঁছায়নি, বাঁধ ভাঙনের ঝুঁকি রয়েছে এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে মানুষের দুর্ভোগ ক্রমাগত বাড়ছে।⸻বঙ্গোপসাগরে ভূমিকম্প: নতুন বিপদের বার্তাগত সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ৫.৮ এবং ৬.১ মাত্রার দুটি ভূমিকম্প রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর (BMD) ও USGS।যদিও এগুলো প্রত্যক্ষ ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়নি, তবে ভূতত্ত্ববিদরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এরকম ভূমিকম্প যদি আরও শক্তিশালী হয় কিংবা সুনামি সৃষ্টি করে, তাহলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো নতুন করে ভয়াবহ প্লাবনের মুখোমুখি হতে পারে।বিশেষজ্ঞের মত:“বঙ্গোপসাগরে ভূমিকম্প উপকূলবর্তী অঞ্চলে সুনামির আশঙ্কা তৈরি করে। দুর্বল বাঁধ ও বন্যাকবলিত অবস্থায় এমন ঢেউ ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।”— ড. মেহেদী হাসান, ভূতত্ত্ববিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ভূমিকম্প + বন্যা = সাম্ভব্য দ্বৈত বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে কি দেশ ?১। সুনামি হলে উপকূলীয় বাঁধ ভেঙে নতুনভাবে বন্যা প্রবেশ করতে পারে।২। নদীপথে ধস হলে ভূমিকম্পের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে স্থায়ী প্লাবন ঘটতে পারে।৩। বাঁধ দুর্বলতার কারণে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ যদি ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে, পানি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে।এর ফলে মানবিক সংকটে পরতে পারে দেশ এবং দুর্বল এলাকায় মানুষ আশ্রয়হীন হবে, খাবার ও চিকিৎসার সংকট বাড়বে।প্রশাসনের প্রস্তুতি ও সীমাবদ্ধতাঃ✳ কী করা হয়েছে:• Flood Forecasting and Warning Centre (FFWC) থেকে নিয়মিত সতর্কতা প্রচার।• দুর্যোগ মোকাবেলায় ৩৩টি জেলায় প্রশাসনিক টাস্কফোর্স গঠন।• রেড ক্রিসেন্ট ও সরকারি সংস্থার মাধ্যমে ৫,০০০+ পরিবারকে নগদ সহায়তা।• উপকূলীয় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত এবং খাদ্য মজুদ নিশ্চিত করা হয়েছে।❌ কী ঘাটতি রয়েছে:• অনেক বাঁধে সংস্কার কাজ এখনো অসম্পূর্ণ।• আশ্রয়কেন্দ্রের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।• অধিকাংশ জেলার ড্রেনেজ ব্যবস্থা দুর্বল — বৃষ্টির পানি জমে দ্রুত জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে।• ভূমিকম্পের পরবর্তী সুনামি প্রস্তুতি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঢিলেমি।⸻🔄 বিশ্লেষণ: কেন ভয়াবহ হতে পারে পরবর্তী ধাক্কাচলমান বন্যা পরিস্থিতিতে মানুষ যখন নিদারুণ দুর্ভোগে, তখন সাগরে ভূমিকম্পের নতুন করে দেখা দেওয়া আশঙ্কা একে দ্বৈত দুর্যোগ (compound disaster) রূপে দেখছে অনেক বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা।বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (WFP), আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিভাগ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে “heightened flood and seismic alert” ঘোষণা করেছে।তাদের মতে, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে শুধুমাত্র বন্যা নয়, সমন্বিত ভূমিকম্প ও সুনামি প্রস্তুতিও জরুরি।⸻✳ সুপারিশ: করণীয় কী?1. উপকূলীয় বাঁধ ও নদী তীরবর্তী স্থাপনা দ্রুত সংস্কার ও শক্তিশালীকরণ।2. আশ্রয়কেন্দ্রের পরিমাণ বাড়ানো এবং সেগুলোতে জরুরি খাদ্য, ওষুধ ও জেনারেটর সংরক্ষণ।3. জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো—ভূমিকম্প হলে করণীয় কী, সুনামি সতর্কতা কীভাবে পড়বেন।4. মোবাইল ফোনে অ্যালার্ট সিস্টেম চালু করে সময়মতো বিপদবার্তা পৌঁছানো।5. স্থানীয় পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।6. Forecast-based financing (FbF) ব্যবস্থায় আরও বেশি পরিবারকে আগাম সহায়তা।⸻🔚 উপসংহারঃবাংলাদেশ বরাবরই প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ। ২০২৫ সালের বন্যা ও বঙ্গোপসাগরের ভূমিকম্প একত্রে প্রমাণ করেছে, আমাদের দুর্যোগ প্রস্তুতির কাঠামোকে শুধু প্রতিক্রিয়াশীল নয়—পূর্বাভাসনির্ভর ও সমন্বিত করে তুলতে হবে।এই দ্বৈত হুমকি প্রতিরোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে, আগামীতে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বহুগুণ বাড়তে পারে।⸻তথ্যসূত্র: BMD, FFWC, WFP, UN OCHA, bdrcs.org, USGS, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়