পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক ব্যাক্তি রাম সিং গোঁড় আসছেন শ্রীমঙ্গলে

Uncategorized

বাবলু আচার্য্য মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধিঃ- একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আগামী শনিবার পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ রাম সিং গোঁড়কে শ্রীমঙ্গলে আনা হবে। অনুষ্ঠানটি থাকবে সকলের জন্যে উন্মুক্ত তার নিজের গণনায় ১৩৫, ভোটার আইডিতে ১১৯
শ্রীমঙ্গলের রাম সিং গোঁড়-ই পৃথিবীর প্রবীণ পুরুষ

বিকুল চক্রবর্তী: মৌলভীবাজার ২১শে টেলিভিশন ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
গিনিচ বুক অব রেকর্ড অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষ মানুষের বয়স ১১১ বছর। আর বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলের মেকানীছড়ার রাম সিং গোঁড় এর বয়স ১৩৫ প্লাস যার ভোটার আইডি কার্ড অনুযায়ী বয়স ১১৯ প্লাস। এই হিসেবে রাম সিং গোঁড়ই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। এখন প্রয়োজন তার সমস্ত রেকর্ড গিনিচ বুক রেকর্ড নথিভুক্তকারীদের কাছে প্রেরণ করা।বর্তমানে গিনিচ রেকর্ড অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ মানুষের বয়স ১১১ বছর। যার নাম জন আলফ্রেড টিনিসউড। তিনি ইংল্যান্ডের বসিন্দা। গিনিস ওয়ার্ল্ড ২০২৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তাকে বিশ্বের বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। এর আগে দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলার নাগরিক হুয়ান ভিসেন্তে পেরেজ মোরার ১১৪ বছর বয়সে মারা যান। তবে এ প্রতিবেদকের অনুসন্ধ্যানে বেড়িয়ে আসে আলফ্রেড নয় শ্রীমঙ্গলের রাম সিং গোঁড়ই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ পুরুষ।
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ত্রিপুরা সীমান্তে একটি পাহাড়ী ছড়ায় পৃথক করা গ্রাম। যে গ্রামটি চিরসবুজ, শিতল ও শান্ত একটি গ্রাম।যার দিবসের প্রাণচঞ্চল্য মুহুর্ত গুলো নিশি রাতের নিস্তব্দতার মতো।মানুষ গুলোও প্রকৃতির মতো সরল। এই গ্রামের নাম মেকানীছড়া। তবে আধুনিক যুগেও এই সরলা গ্রামের মানুষ পান করেন ছড়ার পানি ফুটিয়ে। এ গ্রামে রাতের আধাঁরে আলোর সন্নিবেশ ঘটে কুপির বাতিতে। ৫/৭ কিলোমিটারের আগে নেই কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়।নেই মোবাইল নেটওয়ার্কও। অনেকটা আদি মানুষ হিসেবেই আছেন এই গ্রামের বাসিন্দারা।এমনই একটি সংবাদের তথ্য সংগ্রহে সেখানে যাওয়া। এ বিষয়ে এই গ্রামের প্রবীণ ব্যাক্তির সাথে দেখা করতে গিয়ে খোঁজে পাই এই রাম সিং গোঁড়ের। সময়টা ছিল ২০২৩ খ্রি: এর ২৮ নভেম্বর শীতের এক বিকেল। সংঙ্গে ছিলেন শ্রীমঙ্গল উপজেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টীর সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম জাবেদ।তখন রাম সিং অনেকটা অসুস্থ ছিলেন। আমরা যাওয়ার পর ঘরের ভিতর থেকে চেয়ার বের করে দেন রাম সিং এর নাতিন। এর একটিতে আমি বসি অন্যটিতে তিনি। আর তাজুল ইসলাম জাবেদ আমার মোবাইল নিয়ে কিছু ছবি ও ভিডিও ধারণ করলেন।
রাম সিং হেঁটে হেঁটেই বাহিরে আসেন।কৌশল বিনিময়ের পর তার বয়স জিঙ্গেস করতে তিনি বললেন, ১৩৫ বছর।এ কথা শোনার পর আমি অনেকটা কৌতুহলীহয়ে উঠলাম।তাঁকে জানার আগ্রহ বেড়ে গেলো।শুরু হলো একের পর এক প্রশ্ন আর নোট করতে থাকলাম এর উত্তর।জানতে চাইলাম ভোটার আইডি কার্ড আছে কিনা। বললেন আছে। দেখতে চাইলে তিনি চেয়ার থেকে উঠে আস্তে আস্তে ঘরের ভিতরে চলে গেলেন। আমিও তাঁর পেছন পেছন গেলাম। পুরান আমলের একটি টাংঙ্ক (টিনের বাক্স) বের করে তার তালা খোললেন। সেখান থেকে একটি ধুতির ভাজ থেকে বের করে আনলেন ভোটার আইডি কার্ডিটি। ভোটার আইডি কার্ডে তার জন্ম তারিখ লেখা রয়েছে ৬ আগস্ট ১৯০৫ ইংরেজী। তাঁর বাবার নাম বুগুরাম গোঁড়। আর মায়ের নাম কুন্তী গোঁড়। ভোটার আইডি নং- ১০২৪৯১৩৩৮৪।
আলাপ চারিতায় রাম সিং গোঁড় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাঁর পিতার আদি ভুমি ছিল ভারতে। চা চাষের জন্য তার বাবা এবং দাদা এই এলাকায় প্রথম আসেন। তার দাদা ও বাবার হাতে প্রথম পুটিয়াছড়া চা বাগান সৃজন হয়।তার হাতে সৃজন হয় হরিণ ছড়া চা বাগান। যথন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ হয় ১৯১৪/১৫ সালে তখন তিনি বাগানের চকিদার।ইংরেজ সাহেবদের কাছে এই যুদ্ধের কথা শুনেন। ১৯৩৯/৪০ সালে যখন ২য় বিশ্ব যুদ্ধ হয় সেই খবরে তখনও বাগানের মানুষ ভীত ও আতংকগস্থ হন।তখন তিনিও আতংকগস্থ ছিলেন বলে জানান। বাংলা আর উর্দু নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছিল ১৯৫২ সালে। পুলিশের গুলিতে ঢাকায় ছাত্ররা মারা গেলো সেটাও জানালেন।১৯৬৫ খ্রি. শ্রীমঙ্গল বিদ্যাবিল চা বাগানে ইন্ডিয়া পাকিস্তান রায়ট হয়। গুলাগুলি হয়। তখন তিনি বিদ্যাবিল চা বাগানে ছিলেন। সেখান থেকে সরে আসেন পুটিয়ার দিকে।৭১ সালে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ হয় তখন হরিণছড়া চা বাগানের সকল ম্যানেজার স্টাফ পালিয়ে যায়। কিন্তু তিনি পালাননি। তিনি এবং নিরেণ হাদিমা মিলে শ্রমিক সংগ্রহ করে বাগানের পাতা তুলে খেজুরি চা বাগানে পাঠান। পুরো ৯মাস বাগানে থেকে হরিণছড়া চা বাগান রক্ষা করেন। আলাপ চারিতায় তিনি জানালেন, খেজুরি চা বাগানে বিট্রিশ ম্যানেজার ছিলেন হল সাহেব করে একজন। হল সাহেব বাগানের মেয়ে মঙ্গলীকে বিয়ে করেন। মঙ্গলী তার বয়সে অনেক ছোট ছিল। কিন্তু সাহেব বিয়ে করেছেন তাই তাকে মংলীমেম বলে ডাকতে হতো। উল্লেখ্য এই বিট্রিশ নাগরিক হল সাহেব শ্রীমঙ্গল শহরতলীর বর্তামান পাদরী বাংলার পাশে একটি বাংলা বাড়ি তৈরী করেন। এই বাংলো বাড়িও তার সময়ে করা হয়েছে বলে জানান।হল সাহেবের ছেলে রবার্ট হল এর নামে শ্রীমঙ্গলে একটি সড়কও আছে বলে জানান তিনি।
রাম সিং গোঁড় আরো জানান, তিনি শ্রীমঙ্গলের প্রাচীন বিদ্যাপিঠ ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখায় ৩য় শ্রেণী পরযন্ত পড়েছেন। তখন ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এক পাশে পাকা ঘর লোহার ফিলার ছিল আর এক পাশে ছিল ছনের ঘর। এই ছনের ঘরে তিনি ক্লাস করতেন।তখন তিনি মৌলভীবাজার সড়কের কোন এক আচার্য্য বাড়িতে থেকে পড়তেন। এ সময় শ্রীমঙ্গলে পাকা সড়ক হয়নি।তার ভাষ্যমতে পাকা ঘর বলতে শ্রীমঙ্গল পুরাতন বাজারে একটি ত্রিপুরা রাজ্য ব্যাংক, রামরতন বানিয়ার বাসা ও জগন্নাথ জিউর আখড়ার পশ্চিমে ত্রিপুরা রাজার বাংলো ছিল। মাঝেমধ্যে ত্রিপুরা রাজা হাতির পিঠে চড়ে এই বাংলোয় এসে থাকতেন এবং এখান থেকে খাজনা আদায় করতেন বলে জানান।তিনি জানান, চা বাগানে নিজস্ব টলি দিয়ে পাতা আনা নেয়া করা হতো।সেই টলির লাইন স্থাপনও তিনি দেখেছেন এবং সেই লাইনে টলি ঠেলে পাতা পাঠিয়েছেন।
তথ্য যাচাইসহ নানা ব্যস্ততার কারনে রাম সিং গোঁড় এর প্রতিবেদনটি তৈরী করতে বিলম্ব হচ্ছিল। পুন:রায় আরো কিছু তথ্য যাচাই করতে গত ২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকালে প্রচন্ড দাবাদাহের মধ্যে আবারও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টীর সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম জাবেদ ও সবুজ তজু নামে এক আদীবাসী ব্যাক্তিকে নিয়ে তাঁর বাড়িতে যাই।বাড়ির সামনা দিক বন্ধ থাকায় পেছনের দিকে গিয়ে দেখি তাদের ঘরের পেছনের বারান্দায় একটি ব্রেঞ্চে বসে পুরাতন একটি পাকা মেরামত করছেন রাম সিং।আবারও কৌশল বিনিমিয় করে তার পাশে বসলাম।শাররিক অবস্থার খোঁজ নিলাম। আগেরবারের চেয়ে এবার তিনি বেশ সুস্থ।পুরোনো নতুন মিলিয়ে অনেক কথাই হলো।রাম সিং জানান, তার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর প্রায় ৬৫/৬৬ বছর বয়সে ২য় বিয়ে করেন। এই সংসারে তার ৫ ছেলে ও ৩ মেয়ে জন্ম নেয়। আগের সংসারে শুধু একটি মেয়ে ছিল। আগের সংসারের মেয়ে ও পরের সংসারের বড় ছেলে ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। ছেলে মেয়ের ঘরের একাধিক নাতনী বিয়ে দিয়েছেন তাদের সন্তানও ১৫/১৬ বছরের।তার ছেলে মেয়ে, নাতি পুতি মেয়ের জামাই, নাতিন জামাই, পুত্রবধু মিলিয়ে জীবিত সদস্য সংখ্যা ৭০ এর উপরে বলে জানান, তার চতুরর্থ ছেলে জগদীশ গোঁড়। এখন সবাই আলাধা আলাধা থাকেন। তিনি থাকেন তার ৪র্থ ছেলের সাথে। তার নাতিনী মামনী গোঁড় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানায়, তার দাদা এখনও বেতের জিনিশ তৈরী করতে পারেন।ঘরের টুকটাক কাজও করেন। এ সময় তিনি বাঁশ বেতের তৈরী নতুন একটি পাকা এনে বললেন, প্রচন্ড গরম পড়েছে, তাদের বিদ্যুৎ নেই। তাই দাদা কয়েকদিন আগে এই পাকা তৈরী করেছেন।এ সময় চোখে পড়লো রাম সিং ধারালো দা দিয়ে পুরাতন একটি পাকার জন্য বাঁশের কাটি মসরিন করছেন। অতপর বড় একটি সুই-এ নিজেই সুতা প্রবেশ করালেন এবং এটি দিয়ে পাকাটি সিলি করলেন।একশো ৩৫ বছর বয়সে এসেও তিনি এখনও কাজ করছেন। এ সময় পুত্র জগদীশ বললেন, টাকা পয়সার অভাবে বাবাকে ফলমুল, হরলিক্স খেতে দিতে পারেন না। ডাক্তার বলেছে হরিলিক্স খাওয়ালে শরীরে শক্তি আসবে।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গলের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ শিক্ষক দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্য্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাম সিং শ্রীমঙ্গলের যে সকল বর্ণনা দিয়েছেন তাতে নি:সন্দেহে অনুমান করাযায় তিনি একজন অতি প্রবীণ মানুষ। তিনি বলেন, আমার বয়স ৮০ বছর। ছোট বেলায় আমি পুরানবাজারে ত্রিপুরা রাজ্য ব্যাংকের ভগ্নাংশ দেখেছি। আর শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ১৯২৪ খ্রি. স্থাপিত হলেও প্রাথমিক শাখা স্থাপিত হয়েছে তারও অনেক আগে। যেহেতু ভোটার আইডি কার্ডে তাঁর জন্ম লিখা রয়েছে ১৯০৫ সালে সে হিসেবেও তিনি ১১৯ বছর।তিনি জানান, যারা শতবছর অতিক্রম করবেন এমন মানুষদের চিকিৎসাসহ অনান্য সেবাযত্ন ও সুযোগ সুবিধা সরকারের দেয়া উচিৎ। গিনিচ বুকেও তাঁর নাম পাঠানো উচিৎ এ জন্য সরকারের পাশাপাশি চা বাগান কর্তৃপক্ষও এগিয়ে আসতে পারেন।
এ ব্যাপারে হরিণছড়া চা বাগানের ৮০ বছর বয়সী নিরেণ হাদিমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তিনি ১৯৬১ সালে হরিণছড়া চা বাগানের স্টাফ হিসেবে যোগ দেন।তখনই তিনি রাম সিং গোঁরকে দেখেছেন বৃদ্ধ। ১৯৭১ সালে হরিণ ছড়া চা বাগান রক্ষায় রাম সিং গোঁড় এর ভুমিকা ছিল প্রবল।তিনি বলেন, স্টাফ বলতে আমি একা এবং শ্রমিক বলতে তিনি ছিলেন। রাম সিং কে অনুরোধ করে অনান্য বাগান থেকে শ্রমিক এনে পাতা তুলে বাগান রক্ষা করেন। যাতে গাছসহ অনান্য মালামাল চুরি না হয় রাম সিং নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তা পাহাড়া দেন।
সুস্থতার সহিত দীর্ঘায়ূ ধরে রাখতে রাম সিং গোঁর এর প্রয়োজন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ভালো খাবার। তবে রাম সিং চান মরার আগে তার গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে তা দেখে যেতে। আর বিদ্যুৎ আসলে আইডিয়ার দেয়া একটি ডিপটিউবল আছে সেটিও চালু হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *